বাংলাদেশে পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন’ পাস করে। এ আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তাঁর মা-বাবার ভরণপোষণ দিতে হবে। কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সে ক্ষেত্রে সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাঁদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করবেন। আর তা না করলে তাঁদের শাস্তি পেতে হবে।
এত দিন কোনো সন্তান তাঁর বাবা-মায়ের ভরণপোষণ না দিলে বা খোঁজখবর না করলে কারও বলার কিছু ছিল না। এখন এই আইনের ফলে সন্তানেরা আর পার পাওয়ার সুযোগ পাবেন না। হয় তাঁদের বাবা-মায়ের ভরণপোষণ দিতে হবে, নয়তো শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এমন একটি আইন থাকায় অনেক বৃদ্ধ মা – বাবা মামলা করে আদালতের আশ্রয় নিয়ে ছেলের কাছ থেকে নিয়মিত ভরণপোষণের খরচ পাচ্ছেন।
পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, কোনো প্রবীণ ব্যক্তি তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনলে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। আইনে বলা হয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তাহলে তাঁরাও একই অপরাধে অপরাধী হবেন। ফলে তাঁদেরও একই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তাঁর বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না। তা ছাড়া সন্তান তাঁর মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেবেন ও পরিচর্যা করবেন।
আইনের ৩-এর (৭) ধারা অনুযায়ী, কোনো বাবা বা মা কিংবা দুজনই সন্তানদের সঙ্গে বসবাস না করে পৃথকভাবে বসবাস করলে, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তান তাঁদের দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা ক্ষেত্রমতো, মাসিক আয় বা বার্ষিক আয় থেকে যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ বাবা বা মা অথবা উভয়কে নিয়মিত দেবেন। অথবা মাসিক আয়ের কমপক্ষে ১০ শতাংশ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের কাজে ব্যয় করবেন।
আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাদা-দাদি, নানা-নানিরও ভরণপোষণ করতে হবে। তবে বাবা যদি বেঁচে থাকেন তাহলে সন্তানকে দাদা-দাদির এবং মা বেঁচে থাকলে নানা-নানির ভরণপোষণ করতে হবে না।
এ আইনের অধীনে অপরাধ হবে আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপসযোগ্য। আদালত ইচ্ছা করলে প্রথমেই বিষয়টি আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। আপস-নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার কিংবা ক্ষেত্রমতে, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর কিংবা অন্য যেকোনো উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠাতে পারবে। আদালত থেকে কোনো আপস-মীমাংসার জন্য পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বাবা, মা এবং সন্তান উভয় পক্ষের শুনানি শেষে নিষ্পত্তি করতে পারবেন। কোনো অভিযোগ এভাবে নিষ্পত্তি হলে তা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।
পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন পাস হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন আদালতে এ আইনে মামলা হয়েছে। কিন্তু সে সংখ্যা খুবই নগণ্য। সম্ভবত আইনটি সম্পর্কে বয়স্ক নাগরিকদের না জানার কারণে মামলার সংখ্যা এত কম।
যাঁদের জন্য এ আইন, সেই বয়স্ক ব্যক্তিদের আইনটি সম্পর্কে জানাতে হবে। আইন তৈরি করেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আইন তৈরির পরে জনগণকে তা অবহিত করতে হবে। গেজেট পাস মানেই জনগণকে জানানো হলো, তা নয়। জনগণকে আইন সম্পর্কে জানানো ও আইন মানতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের দেশের বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা যদি জানতে পারেন যে তাঁদের পক্ষে এমন একটি আইন রয়েছে, তা হলে অনেকেই আইনের আশ্রয় নেবেন। কাজেই গণমাধ্যমগুলোতে এই আইন সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার চালাতে হবে। তা না হলে এই আইন কাগুজে আইন হয়েই থাকবে।
0 Comments